গণিত! নামটা শুনলেই অনেকের কপালে ভাঁজ পড়ে, তাই না? কিন্তু আমি বলি কি, গণিতকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বরং, কিছু শর্টকাট ট্রিকস আর জাদু জানলে, এটা হয়ে উঠতে পারে তোমার সবচেয়ে পছন্দের বিষয়। বিশেষ করে ক্লাস ৬ থেকে ১০ পর্যন্ত, এই সময়টাতেই গণিতের ভিত্তিটা শক্ত করা খুব জরুরি। তাহলে চলো, আজ আমরা কিছু মজার গণিতের শর্টকাট ট্রিকস শিখি, যা তোমাদের স্কুলের পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে সাহায্য করবে, আর গণিতকে করবে আরও মজাদার!

Table of Contents

গণিতের শর্টকাট কেন প্রয়োজন?

গণিতকে সহজ করার জন্য শর্টকাট পদ্ধতির বিকল্প নেই। পরীক্ষার হলে সময় বাঁচানো, জটিল সমস্যাকে সহজে সমাধান করা এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য শর্টকাট টেকনিক জানা খুবই জরুরি। বিশেষ করে যখন তোমরা ক্লাস ৬ থেকে ১০-এর ছাত্র-ছাত্রী, তখন এই বিষয়গুলো তোমাদের জন্য আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

শর্টকাট শেখার সুবিধা

  • সময় সাশ্রয়: পরীক্ষার হলে দ্রুত অঙ্ক করার জন্য শর্টকাট পদ্ধতি খুব দরকারি।
  • জটিল সমস্যা সমাধান: কঠিন অঙ্কগুলো সহজে করার জন্য এটা দারুণ।
  • আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি: অঙ্ক যখন সহজে হয়ে যায়, তখন নিজের ওপর বিশ্বাস বাড়ে।
  • গণিতের ভয় দূর: শর্টকাট ব্যবহার করার কারণে গণিতকে আর কঠিন মনে হয় না।

গুণ করার কিছু অসাধারণ শর্টকাট

গুণ করাটা অনেকের কাছেই ঝামেলার মনে হয়। কিন্তু কিছু সহজ কৌশল জানা থাকলে, এটা হয়ে উঠবে পানির মতো সহজ। নিচে কয়েকটি জনপ্রিয় শর্টকাট আলোচনা করা হলো:

১১ দিয়ে গুণ করার নিয়ম

যদি কোনো সংখ্যাকে ১১ দিয়ে গুণ করতে হয়, তাহলে একটা সহজ কৌশল আছে। ধরো, আমরা ২৩-কে ১১ দিয়ে গুণ করব।

  • প্রথমে ২ আর ৩ একটু ফাঁকা করে লিখি: ২ _ ৩
  • এবার ২ আর ৩ যোগ করে মাঝখানে বসিয়ে দিই: ২(২+৩)৩ = ২৫৩

তাহলে, ২৩ x ১১ = ২৫৩।

এটা শুধু দুই অঙ্কের সংখ্যার জন্য প্রযোজ্য। তিন বা তার বেশি অঙ্কের সংখ্যার ক্ষেত্রে নিয়মটা একটু আলাদা।

তিন অঙ্কের সংখ্যাকে ১১ দিয়ে গুণ

ধরা যাক, আমাদের ৩২৫ কে ১১ দিয়ে গুণ করতে হবে।

  • প্রথমে ৩ আর ৫ একটু দূরে লিখি: ৩ _ _ ৫
  • এরপর ৩ + ২ = ৫, এবং ২ + ৫ = ৭। এগুলো মাঝখানে বসাই।
  • তাহলে উত্তর দাঁড়ায়: ৩ ৫৭ ৫

সুতরাং, ৩২৫ x ১১ = ৩৫৭৫।

বেস ১০-এর কাছাকাছি সংখ্যাগুলোর গুণ

যদি দুটি সংখ্যা ১০-এর কাছাকাছি হয়, তবে তাদের গুণ করার একটা সহজ উপায় আছে। উদাহরণস্বরূপ, ৮ এবং ৯ গুণ করা যাক।

  • ১০ থেকে ৮ কত কম? উত্তর: ২
  • ১০ থেকে ৯ কত কম? উত্তর: ১
  • এবার ৮ থেকে ১ বিয়োগ দাও (অথবা ৯ থেকে ২, একই ফল আসবে): ৮ – ১ = ৭
  • শেষে, ২ আর ১ গুণ করো: ২ x ১ = ২
  • তাহলে উত্তর হলো ৭২।

সুতরাং, ৮ x ৯ = ৭২।

৫০-এর কাছাকাছি সংখ্যাগুলোর গুণ

৫০-এর কাছাকাছি সংখ্যাগুলোর গুণ করার জন্য অন্য একটি কৌশল আছে। ধরা যাক, আমরা ৫৪ এবং ৫৬ গুণ করব।

  • প্রথমে ৫৪ থেকে ৫০ কত বেশি? উত্তর: ৪
  • এবং ৫৬ থেকে ৫০ কত বেশি? উত্তর: ৬
  • এবার ২৫ এর সাথে ৪ যোগ করো: ২৫ + ৪ = ২৯
  • তারপর ৪ এবং ৬ গুণ করো: ৪ x ৬ = ২৪
  • সুতরাং, উত্তর হলো ২৯২৪।

সুতরাং, ৫৪ x ৫৬ = ৩০২৪।

বর্গ নির্ণয়ের সহজ উপায়

বর্গ (square) নির্ণয় করা অনেক সময় বেশ কঠিন মনে হয়। কিন্তু কিছু শর্টকাট জানা থাকলে, এটা খুব সহজেই করা যায়।

যে সংখ্যার শেষে ৫ আছে, তার বর্গ নির্ণয়

যদি কোনো সংখ্যার শেষে ৫ থাকে, তাহলে তার বর্গ বের করা খুবই সহজ। যেমন ধরো, আমরা ২৫-এর বর্গ বের করব।

  • প্রথমে ৫-এর বর্গ করি: ৫ x ৫ = ২৫। এটাকে আলাদা করে লিখি।
  • এরপর ২-এর পরের সংখ্যা (অর্থাৎ ৩) দিয়ে ২-কে গুণ করি: ২ x ৩ = ৬।
  • এবার ৬-এর পাশে ২৫ বসিয়ে দিই: ৬২৫

সুতরাং, ২৫-এর বর্গ হলো ৬২৫।

১০০-এর কাছাকাছি সংখ্যার বর্গ

যদি কোনো সংখ্যা ১০০-এর কাছাকাছি হয়, তাহলে তার বর্গ নির্ণয় করার একটা সহজ উপায় আছে। উদাহরণস্বরূপ, ৯৬-এর বর্গ নির্ণয় করা যাক।

  • ১০০ থেকে ৯৬ কত কম? উত্তর: ৪
  • ৯৬ থেকে ৪ বিয়োগ দাও: ৯৬ – ৪ = ৯২
  • ৪-এর বর্গ করো: ৪ x ৪ = ১৬
  • তাহলে উত্তর হলো ৯২১৬।

সুতরাং, ৯৬-এর বর্গ হলো ৯২১৬।

ভগ্নাংশের যোগ-বিয়োগের সহজ নিয়ম

ভগ্নাংশের যোগ-বিয়োগ অনেকের কাছেই জটিল মনে হয়। কিন্তু কিছু নিয়ম জানা থাকলে, এটা খুব সহজেই করা যায়।

যখন হর একই থাকে

যদি দুটি ভগ্নাংশের হর একই থাকে, তাহলে তাদের যোগ বা বিয়োগ করা খুব সহজ। যেমন, ২/৫ + ১/৫ = (২+১)/৫ = ৩/৫।

যখন হর ভিন্ন থাকে

যদি হর ভিন্ন থাকে, তাহলে প্রথমে হরগুলোর ল.সা.গু (LCM) বের করতে হয়। তারপর সেই ল.সা.গু দিয়ে উভয় ভগ্নাংশকে গুণ করে যোগ বা বিয়োগ করতে হয়।

উদাহরণ: ১/৩ + ১/৪

  • ৩ এবং ৪-এর ল.সা.গু হলো ১২।
  • এবার, (১/৩) x (৪/৪) = ৪/১২ এবং (১/৪) x (৩/৩) = ৩/১২
  • সুতরাং, ৪/১২ + ৩/১২ = ৭/১২

বীজগণিতের কিছু দরকারি সূত্র ও তার ব্যবহার

বীজগণিতের সূত্রগুলো ভালোভাবে জানা থাকলে অনেক অঙ্ক সহজেই করা যায়। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র এবং তাদের ব্যবহার আলোচনা করা হলো:

(a + b)² = a² + 2ab + b²

এই সূত্রটি ব্যবহার করে অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করা যায়।

উদাহরণ: (x + ২)² = x² + ২x২ + ২² = x² + 4x + 4

(a – b)² = a² – 2ab + b²

এই সূত্রটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

উদাহরণ: (y – ৩)² = y² – ২y৩ + ৩² = y² – 6y + 9

a² – b² = (a + b)(a – b)

এই সূত্রটি ব্যবহার করে অনেক সংখ্যার বর্গমূল সহজে বের করা যায়।

উদাহরণ: ১৬ – ৯ = (৪ + ৩)(৪ – ৩) = ৭*১ = ৭

শতকরা হিসাবের সহজ উপায়

শতকরা হিসাব করাটা প্রায় সব ক্ষেত্রেই লাগে। তাই এটা ভালোভাবে জানা থাকা দরকার।

শতকরা বের করার নিয়ম

যদি কোনো সংখ্যার শতকরা বের করতে হয়, তাহলে প্রথমে সংখ্যাটিকে ১০০ দিয়ে ভাগ করতে হয়, তারপর যত শতাংশ বের করতে বলা হয়েছে, সেই সংখ্যা দিয়ে গুণ করতে হয়।

উদাহরণ: ২৫০-এর ২০% কত?

  • প্রথমে ২৫০-কে ১০০ দিয়ে ভাগ করি: ২৫০/১০০ = ২.৫
  • তারপর ২.৫-কে ২০ দিয়ে গুণ করি: ২.৫ x ২০ = ৫০
  • সুতরাং, ২৫০-এর ২০% হলো ৫০।

শতকরা বৃদ্ধি বা হ্রাস

যদি কোনো সংখ্যা শতকরা হারে বাড়ে বা কমে, তাহলে তার হিসাব করার নিয়ম হলো:

  • বৃদ্ধি পেলে: নতুন মান = পুরনো মান + (পুরনো মানের শতকরা বৃদ্ধি)
  • হ্রাস পেলে: নতুন মান = পুরনো মান – (পুরনো মানের শতকরা হ্রাস)

গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর (FAQ)

গণিতের শর্টকাট নিয়ে তোমাদের মনে অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে। নিচে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:

গণিতের শর্টকাট কি সবসময় কাজে লাগে?

গণিতের শর্টকাট সবসময় কাজে নাও লাগতে পারে। এটা নির্ভর করে অঙ্কটা কেমন, তার ওপর। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শর্টকাট ব্যবহার করে দ্রুত ফল পাওয়া যায়।

শর্টকাট শিখতে কি অনেক সময় লাগে?

প্রথমদিকে একটু সময় লাগতে পারে, কিন্তু একবার শিখে গেলে এটা খুবই সহজ হয়ে যায়। নিয়মিত অনুশীলন করলে এটা আয়ত্ত করা সম্ভব।

কোন ক্লাসের জন্য এই শর্টকাটগুলো বেশি উপযোগী?

এই শর্টকাটগুলো মূলত ক্লাস ৬ থেকে ১০-এর ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বেশি উপযোগী। তবে যারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তাদের জন্যও এটা খুব কাজে দেবে।

গণিতের দুর্বলতা কাটানোর উপায় কী?

গণিতের দুর্বলতা কাটানোর জন্য নিয়মিত অনুশীলন করা, শিক্ষকের সাহায্য নেওয়া এবং বেসিক বিষয়গুলো ভালোভাবে বোঝা দরকার। এছাড়া, শর্টকাট টেকনিকগুলো ব্যবহার করে গণিতকে সহজ করে তোলা যায়।

গণিত ভীতি দূর করার উপায় কী?

গণিত ভীতি দূর করার জন্য প্রথমে গণিতকে মজার মনে করতে হবে। ছোট ছোট অঙ্ক দিয়ে শুরু করে ধীরে ধীরে জটিল অঙ্কগুলোর সমাধান করতে হবে। এছাড়া, বন্ধুদের সাথে আলোচনা করে এবং শিক্ষকের সাহায্য নিয়ে গণিতের ভয় দূর করা যায়।

অতিরিক্ত কিছু টিপস

গণিতকে আরও সহজ করার জন্য নিচে কিছু অতিরিক্ত টিপস দেওয়া হলো:

  • নিয়মিত অনুশীলন করো।
  • গণিতের বেসিক বিষয়গুলো ভালোভাবে বোঝো।
  • শিক্ষকের সাহায্য নিতে দ্বিধা করো না।
  • বন্ধুদের সাথে আলোচনা করো।
  • গণিতকে মজার মনে করো।
  • শর্টকাট টেকনিকগুলো ব্যবহার করো।

গণিত শেখার কিছু ওয়েবসাইট ও অ্যাপ

বর্তমানে অনলাইনে গণিত শেখার অনেক ওয়েবসাইট ও অ্যাপ রয়েছে। Khan Academy, Mathway এবং Photomath এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো তোমাদের গণিত শেখা আরও সহজ করে তুলতে পারে।

গণিত অলিম্পিয়াড ও প্রতিযোগিতা

গণিতকে ভালোবাসতে এবং নিজের দক্ষতাকে যাচাই করতে গণিত অলিম্পিয়াড ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারো। এতে তোমাদের সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়বে এবং নতুন কিছু শেখার সুযোগ তৈরি হবে।

উপসংহার

গণিতের শর্টকাটগুলো শেখা শুধু পরীক্ষার জন্য নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজে লাগে। এই কৌশলগুলো তোমাদের সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং গণিতের প্রতি ভীতি দূর করে। নিয়মিত অনুশীলন এবং সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে তোমরাও গণিতে দক্ষ হয়ে উঠতে পারো।
আজ থেকেই শুরু করো, আর দেখো, গণিত তোমার কাছে কতটা সহজ হয়ে যায়! গণিত নিয়ে ভয় নয়, জয় হোক তোমার!